বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের নেপথ্যের আসল কাহিনী
বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের নেপথ্যের আসল কাহিনী । সম্প্রতি পত্রিকায় খবর এসেছে, ইউনুস সরকার দায়িত্ব নেবার মাত্র ১১ মাসের কম সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে নতুন মুদ্রা ছাপিয়ে আর্থিকভাবে দুর্বল ১২টি ব্যাংককে সাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকার সহায়তা সরবরাহ করেছে।
চন্দন আজিজ ভাইয়ের লেখা।
ওরে বাটপার! ওরে বাটপার!!
শুরু হয়ে গেছে মাতম!
আসুন, দেখি- আসলেই কি লুটপাট চলমান?
এই ৫২,৫০০ কোটি টাকার মধ্যে ১৯,০০০ কোটি টাকা কোনো ব্যাংককে দেওয়া হয়নি। বরং, কয়েকটি ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি টাকাকে ঋণে রুপান্তর করা হয়েছে।
প্রথমেই প্রশ্ন আসে, চলতি হিসাবে ঘাটতি কেমন করে হলো?
দেশের সব ব্যাংকের ব্যাংক হলো বাংলাদেশ ব্যাংক। সব ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকে চলতি হিসাব মেইনটেইন করে।
নিয়ম অনুযায়ী, যেকোনো ব্যাংকের বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত চলতি হিসাবে সেই ব্যাংকের সকল আমানতকারীর জমা করা মোট আমানতের ন্যূনতম ৪% টাকা জমা থাকবে।
আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের চলতি হিসাবে নেগেটিভ ব্যালান্স বা ঘাটতি থাকার অবকাশ নেই।
অথচ দেখুন- ১৪.০৮.২০২৪ এর সমকাল পত্রিকার খবর অনুযায়ী ৭ টি ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিলো ২৯ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা:
ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক: ১০ হাজার ৬১১ কোটি টাকা
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ: ৭ হাজার ১২৮ কোটি টাকা
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক: ৪ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা
ন্যাশনাল ব্যাংক: ৩ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা
ইউনিয়ন ব্যাংক: ২ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক: ৭১২ কোটি টাকা
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক: ৩৯২ কোটি টাকা
কেমন করে সম্ভব হলো এই আচানক ঘটনা?
পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ সরকার এই ঘটনার কুশীলব। কতিপয় ব্যক্তিকে দেশ লুটের সুযোগ করে দিতে এই কুলাঙ্গার বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট খুলে দিয়েছিলো।
ব্যাংক লুটেরারা নিজেদের ব্যাংকের আমানতকারীদের সব টাকা লুটে নিয়ে থামেনি, বাংলাদেশ ব্যাংকও লুট করেছে। এ কাজে তাদের সহায়তা করেছে স্বয়ং গভর্নর। কী লজ্জা!
বর্তমান সরকার সেই চলতি হিসাবগুলোর নেগেটিভ ব্যালান্সগুলোকে ঋণে পরিণত করেছেন। ১৯,০০০ কোটি টাকা লোনে রুপান্তর করার পাশাপাশি ১০,৫৯৭ কোটি টাকা আদায়ও করেছেন।
বাহবা দেবেন না?
১৯,০০০ কোটি টাকার সুলুক পেলেন। বাকি ৩৩,৫০০ কোটি টাকা কোথায় গেলো?
এই টাকাগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক ধার দিয়েছে কয়েকটি ব্যাংককে।
কেনো ধার দিলো?
ধার দিয়েছে, কারণ কয়েকটি ব্যাংক তাদের আমানতকারীদের আমানত ফেরত দিতে পারছিলো না।
কেনো আমানত ফেরত দিতে পারছিলো না?
কারণ লুটেরা হাসিনার কয়েকজন সহযোগী প্রায় বিনা বাধায় দেশের কয়েকটি ব্যাংক লুট করেছে।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মোট আমানত ৪৫,০০০ কোটি টাকা (প্রায়), মোট ঋণ ৬০,০০০ কোটি টাকা (প্রায়)। ঋণের প্রায় পুরোটাই লুট করে নিয়ে গেছে এস আলম।
ইউনিয়ন ব্যাংকের মোট আমানত ২৪,০০০ কোটি টাকা (প্রায়), মোট ঋণ ২৭,০০০ কোটি টাকা (প্রায়)। ঋণের প্রায় পুরোটাই লুট করে নিয়ে গেছে এস আলম।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের মোট আমানত ১২,০০০ কোটি টাকা (প্রায়), মোট ঋণ ১৩,০০০ কোটি টাকা (প্রায়)। ঋণের প্রায় পুরোটাই লুট করে নিয়ে গেছে এস আলম।
ন্যাশনাল ব্যাংক লুট করেছে জয়নুল হক শিকদারের পরিবার, এস আলম ও অন্যরা।
এক্সিম ব্যাংক লুট করেছে নজরুল ইসলাম মজুমদার ও অন্যরা।
পদ্মা ব্যাংক লুট হয়েছে।
আইএফআইসি ব্যাংক লুট হয়েছে।
জনতা ব্যাংক লুট হয়েছে।
ইউসিবি লুট হয়েছে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লুট হয়েছে।
ইসলামী ব্যাংক লুট হয়েছে।
৫ই আগস্টের পর এসব লুটপাটের খবর প্রকাশ হয়ে যায়। তখন সাধারণ আমানতকারীরা এসব ব্যাংকের শাখায় নিজেদের আমানত ফেরত পেতে ভিড় করেন।
উদ্ভব হয় এক নজিরবিহীন পরিস্থিতির। গ্রাহক ব্যাংকে আমানত ফেরত নিতে এসেছেন, ব্যাংক টাকা ফেরত দিতে পারছেন না। হাউকাউ, হট্টগোল- যা তা অবস্থা!
পরিস্থিতি এমন গুরুতর হয়েছিলো যে, কিছু ব্যাংকের শাখার কর্মীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, গ্রাহকরা কিছু ব্যাংকে তালা লাগিয়ে দিয়েছিলেন, অনেক ব্যাংকের চেক অনার হচ্ছিলো না, অনেক ব্যাংকের অনলাইন লেনদেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এমনকি, কিছু ব্যাংকের কর্মীরা বেতন পাচ্ছিলেন না।
পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে লুট হওয়া ব্যাংকগুলোকে শুধুমাত্র গ্রাহকদের আমানত ফেরত দেবার শর্তে অল্প অল্প করে লিকুইডিটি সাপোর্ট দিয়েছে।
১২ টা ব্যাংককে লিকিউডিটি সাপোর্ট দেয়া হয়েছে ৩৩,৫০০ কোটি টাকা। এইসব ব্যাংকের সর্ব, মোট আমানতের ৫% এরও কম হবে এই এমাউন্ট। তাও, একবারে নয়; সময়ে সময়ে, অল্প অল্প করে দেয়া হয়েছে এই তারল্য সহায়তা।
এই লিকিউডিটি সাপোর্ট দিয়ে আদতে জনগণের আতঙ্ক কমানো হয়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থার ওপরে সাধারণ মানুষের আস্থা টিকিয়ে রাখতে এই সাপোর্ট না দিয়ে উপায় ছিলো না।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিগত এগারো মাসে অবিশ্বাস্য দৃঢ়তা দেখিয়েছে। এর ১% মেরুদণ্ড যদি ২০১৭-২০২৩ সময়কালে তারা দেখাতে পারতো, বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রি এই গভীর সংকটে পড়তো না।
যেকোনো বিবেকবান মানুষই বলবেন, বাংলাদেশ ব্যাংক শুধুমাত্র দেশ ও অর্থনীতির স্বার্থে এই ৫২,৫০০ কোটি (আদতে ৩৩,৫০০ কোটি) টাকার তারল্য সহায়তা দিয়েছে ধ্বসে যাওয়া ব্যাংকগুলোকে। দেশে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখতে এই পদক্ষেপের তেমন কোনো বিকল্প ছিলো না।
অথচ!
শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দেশনা ও সহায়তায় দেশের ব্যাংক লুটে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন এস আলম, সালমান এফ রহমান, আজিজ খান, সাইফুজ্জামান, নাফিস শরাফতেরা।
সেই লুটপাটের কারণে সৃষ্ট সংকট থেকে দেশকে উদ্ধার করতে নিজেদের সব মেধা আর পরিশ্রম বিনিয়োগ করেছেন অর্থ উপদেষ্টা এবং গভর্নর মহোদয়। তাদের সেই পরিশ্রম এবং প্রচেষ্টা সফলও হয়েছে অনেকাংশে।
এখন, লুটেরাদের সফট সমর্থকেরা গর্ত থেকে হুক্কাহুয়া ডাক দিচ্ছে- গেলো, গেলো। আমি বলি- লুট করেছে কে? তোদের আম্মা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ। কিন্তু, বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অর্থনীতির রক্ষাকবচের ভূমিকায় আপাতত সফল- এ কথা অনস্বীকার্য।
ওদিকে আরেক বাটপার নাকি ফেইসবুকে প্রচার করছে, হাসিনার সময়ে দেশের মোট খেলাপী ঋণ ছিলো মোট ঋণের ৭%, হাসিনা পালানোর পর সেটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৭% এ। হাসিনার অভাবে দেশের এই হাল!
ওরে বাটপার! ওরে বাটপার!!
চন্দন আজিজ ভাইয়ের লেখা।
No comments